রবিবার, ২৪ জুন, ২০১২

জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা


আ বু ল কা সে ম ফ জ লু ল হ ক 
রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে হব্স্, লক্, র“শো ও এঙ্গেলসের মতো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্যবইতে আমরা পড়ি। আমরা কখনও ভেবে দেখেছি কি, বাংলায়, পাঞ্জাবে, মহারাষ্ট্রে, সিন্ধুতে ও উত্তরপ্রদেশেও এক সময় রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছিল? এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়াÑ সব মহাদেশের সব দেশেই আলাদাভাবে রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছিল। বাংলা ভাষার দেশে আদিতে গাঁই বা গঁয়ী, জনপদ, জনপদ রাজ্য, রাজ্য ইত্যাদির উদ্ভব, ঠিকানা ও বিলয়ের কথা ইতিহাসবিদরা কেউ কেউ বলেছেন। রাষ্ট্রের উদ্ভব, বিকাশ ও বিলয়ের ব্যাপারটি বোঝার জন্য এঙ্গেলসের ঞযব ঙৎরমরহ ড়ভ ঋধসরষু চৎরাধঃব চৎড়ঢ়বৎঃু ধহফ ঝঃধঃব (পরিবার ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি) বইটি খুবই সহায়ক। মানুষের সমাজে প্রভু ও দাস (সধংঃবৎং ধহফ ংষধাবং), সামন্ত প্রভু ও ভূমিদাস (ভবঁফধষ ষড়ৎফং ধহফ ংবৎভং), রাজা ও প্রজা (শরহম ধহফ ংঁনলবপঃং) ইত্যাদি ছিল। ভারত উপমহাদেশে ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদ ও জাতিভেদ প্রথা। নারী-পুর“ষ সম্পর্ক ও পরিবার ব্যব¯’ায় বৈচিত্র্য এবং বিবর্তন আছে। সতীদাহ প্রথা পর্যন্ত ছিল। মানুষের স্বভাব ও আচরণও বিবর্তনের ধারায় আছে। সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশও বিকাশশীল। 
আধুনিক গণতন্ত্র ও জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে রেনেসাঁস ও শিল্পবিপ্লবের কারণে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উত্থান-পতনেরও ইতিহাস আছে। 
দেশ ও রাষ্ট্র এক নয়। দেশ প্রকৃতির সৃষ্টি, রাষ্ট্র মানুষের। পাহাড়, পর্বত, সমুদ্র, মর“ভূমি ইত্যাদি দুর্লঙ্ঘ্য প্রাকৃতিক নানা কিছু দ্বারা পরিবেষ্টিত এক একটি সুবিশাল এলাকা হল এক একটি দেশ। প্রত্যেক দেশের অভ্যন্তরে ভৌগোলিক ও নৃগোষ্ঠীগত নানা বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। দেশের সীমানাও সমরূপ (ঁহরভড়ৎস) হয় না। রাষ্ট্রের রূপ ও প্রকৃতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নির্ণয় করার চেষ্টা করেছেন। 
সীমানা দ্বারা চিহ্নিত সুনির্দিষ্ট ভূভাগ, সেই ভূভাগের সুনির্দিষ্ট জনগণ, সেই ভূভাগে সেই জনগণের সরকার এবং সেই ভূভাগ ও সেই জনগণের যে কোন বিষয়ে সেই জনগণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের চূড়ান্ত ক্ষমতা বা সার্বভৌমত্বÑ এই চারটি বিষয় হল রাষ্ট্রের রূপ ও প্রকৃতি নির্দেশক মূল ব্যাপার। আসলে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতাই হল রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, যার মালিক জনগণ। রাষ্ট্রের থাকে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, যেমনÑ আইনসভা ও মন্ত্রিপরিষদ, নির্বাহী বিভাগ বা প্রশাসন ব্যব¯’া এবং আইন ও বিচার ব্যব¯’া। ইউরোপে রেনেসাঁসের ফলে গির্জার কর্তৃত্ব, ধর্মতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের বির“দ্ধে আধুনিক গণতন্ত্র এবং জনগণের সার্বভৌমত্বের ধারণা দেখা দেয়। একমাত্র ঈশ্বরকেই মনে করা হতো সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। রাজতন্ত্র ও গির্জার কর্তৃত্বের পক্ষে তখন বাইবেলীয় বা কোরআনীয় যুক্তি প্রদর্শন করা হতো। আধুনিক গণতন্ত্রের ধারণা বিকশিত হওয়ার আগে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংগঠন করার স্বাধীনতা ইত্যাদি স্বীকার করা হতো না। স্টিম ইঞ্জিন, ইঞ্জিনচালিত যানবাহন ও কলকারখানা, মুদ্রণযন্ত্র ইত্যাদির প্রচলনই শিল্পবিপ্লব। শিল্পবিপ্লবের আগে মানুষের কর্মকাণ্ড ও জীবনপ্রয়াস দেশব্যাপী বিস্তৃত হয়নিÑ সবই সীমাবদ্ধ ছিল ক্ষুদ্র গণ্ডিতে, অঞ্চলে, এলাকায়। শিল্পবিপ্লবের ফলে মানুষের বিচরণ ও সম্পদের আনা-নেয়া দেশব্যাপী বিস্তৃত হয়। মুদ্রিত পত্রপত্রিকা ও বই-পুস্তক ক্রমেই মানুষের ভাবের আদান-প্রদানকে নিবিড়তর করে। মানুষের মধ্যে দেশভিত্তিক ঐক্যবোধ দেখা দিতে থাকে। মাতৃভাষা ও আঞ্চলিক ভাষার বৈচিত্র্য অতিক্রম করে গড়ে ওঠে জাতীয় ভাষা। এক পর্যায়ে অনেক দেশে অনেকের মধ্যে ধারণা দেখা দেয়Ñ আমরা যদি আমাদের দেশে আমাদের জন্য একটি ভালো রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারি, তা হলে সেই রাষ্ট্রে আমাদের সবচেয়ে ভালো জীবনযাপনের উপায় হবে। এই ধারণাই জাতীয়তার ধারণা, এই বোধই জাতীয়তাবোধ, এই চেতনাই জাতীয় চেতনা। এ থেকে দেখা দেয় জাতীয়তাবাদ ও জাতিরাষ্ট্র গঠনের আন্দোলন। ইউরোপে উনিশ শতকে এবং এশিয়ায় বিশ শতকে দেখা দেয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। ইউরোপে প্রত্যেক দেশে রাজতন্ত্র উৎখাত করে গড়ে তোলা হয় জাতিরাষ্ট্র। আর এশিয়ায় প্রত্যেক দেশে ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করে জাতি হয়ে ওঠার এবং স্বাধীনতা-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রয়াস দেখা দেয়। আধুনিক গণতন্ত্রের সার্বভৌমত্বের ধারণা, সেই সঙ্গে জাতিরাষ্ট্রের ধারণা ইউরোপ থেকে পৃথিবীর সব মহাদেশে ও দেশে ছড়িয়ে পড়ে। রাষ্ট্রচিন্তা ও রাষ্ট্র গঠনের বহু বিচিত্র ধারণা বিকশিত হয়। অনেকে মতপ্রকাশ করেন যে, পৃথিবীতে মানবকল্যাণের সর্ববৃহৎ অবলম্বন হল রাষ্ট্র। ইউরোপে প্লেটো থেকেই এই ধারণা বিকশিত হতে থাকে।
ভারতে কৌটিল্যের চিন্তাধারার ধারাবাহিক বিকাশ ঘটেনি। খ্রিস্টীয় মধ্যযুগের ব্যবধান সত্ত্বেও ইউরোপে প্লেটো-এরিস্টটলের চিন্তাধারার ধারাবাহিক বিকাশ ঘটেছে। 
এশিয়ায় ধর্মকে মনে করা হয়েছে মানবকল্যাণের সর্বপ্রধান অবলম্বন। ইউরোপে রাষ্ট্রকে মনে করা হয়েছে মানবকল্যাণে সর্ববৃহৎ অবলম্বন। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ফলে পৃথিবীর সর্বত্রই মানুষের ধ্যান-ধারণা ও চিন্তাভাবনা পরিবর্তিত হয়েছে। 
রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা অপরিহার্য। মৌলিক অধিকার, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও জাতীয় ঐক্যও অপরিহার্য। মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের একটি কথা মনে পড়ে। বিশ দশকের শুর“তে তুরস্কে প্রগতিশীল রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা ও চেষ্টায় অগ্রসর হয়ে তিনি অনুভব করেছিলেন, ‘যে-দেশে স্বাধীনতা থাকে না, সে দেশে কেবল ধ্বংস আর মত্যুর রাজত্ব চলে। সমস্যা থেকে মুক্তি ও সব ক্ষেত্রে প্রগতির মূল উৎস স্বাধীনতা।’ বাংলাদেশকে প্রগতিশীল জনগণের রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলার জন্য যারা চিন্তা ও কাজ করছেন, করবেনÑ তাদের মোস্তফা কামালের এই কথাটার মর্ম, বাংলাদেশের বাস্তবের সঙ্গে মিলিয়ে, অবশ্যই গভীরভাবে বুঝতে হবে। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও অভ্যন্তরীণ স্বায়ত্তশাসন, মৌলিক অধিকার ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ছাড়া বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় এবং জনজীবনের সমস্যাবলির সমাধান করা যাবে? অপচয়, অপব্যয় ও অনাচার দূর করা যাবে? সব ক্ষেত্রে প্রগতির সূচনা করা যাবে? ধ্বংস ও মৃত্যু রোধ করা যাবে?
আমাদের প্রায় দেড় হাজার বছরের লিখিত ইতিহাস আছে। তার পেছনে আছে দীর্ঘ সময়ের আদি-ইতিহাস ও প্রাক-ইতিহাস। আজকের সমস্যা ও সম্ভাবনার পটভূমি হিসেবে এই গোটা ইতিহাসেরই বিচার-বিশ্লেষণ একান্ত দরকার। প্রতিটি ঐতিহাসিক পর্যায়ের প্রগতিশীল, প্রতিক্রিয়াশীল ও রক্ষণশীল শক্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং বিজয়-পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের অগ্রগতিকে বোঝা দরকার। প্রতিক্রিয়াশীলরা নিজেদের হীনস্বার্থে যে কোন নতুন ভালো উদ্যোগকে বাধা দেয়। বাংলাদেশে গোটা ইতিহাসকে বাদ দিয়ে কেবল সাম্প্রতিক পঞ্চাশ-ষাট বছরের ঐতিহাসিক ঘটনাবলি নিয়ে সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে হীন উপায়ে স্বার্থসিদ্ধির আয়োজন করে কারও কারও সাময়িক কিছু লাভ হলেও, শেষ পর্যন্ত তাতে সবারই ক্ষতি। যে ধারায় সবকিছু চালানো হ”েছ তাতে বাংলাদেশে কোন সু¯’, স্বাভাবিক, প্রগতিশীল রাষ্ট্র গড়ে উঠবে না। পরনির্ভরতা পরাধীনতারই নামান্তর। স্বাধীনতার কোন বিকল্প নেই। অবশ্যই স্বাধীনতা আমাদের অর্জন করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছিলাম, তা আমরা রক্ষা করতে পারিনি। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ওপর নির্ভরশীল হতে হতে আমরা আমাদের অর্জিত স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলেছি। 
বাংলা ভাষার দেশে দীর্ঘকাল ধরে নিজেদের রাষ্ট্র আকাক্সক্ষা করা হয়েছে। তার জন্য রাজনৈতিক আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, স্বাধীনতা যুদ্ধÑ ইত্যাদি করা হয়েছে। কিš‘ কেমন যেন উš§াদনার মধ্য দিয়ে ঈর্ষা-বিদ্বেষ, হানাহানি, রক্তারক্তির মধ্য দিয়ে সময় কেটে গেছেÑ রাষ্ট্র্র গঠন হয়নি। রাষ্ট্র গঠন নিয়ে বাস্তবসম্মত গভীর চিন্তাভাবনাও করা হয়নি। 
ব্রিটিশ শাসনামলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পর্যায়ে আমরা পাই সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ, হিন্দু জাতীয়তাবাদ এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদ। ভারতে বাঙালি, পাঞ্জাবি, রাজপুত, মারাঠি ইত্যাদি অন্তত ১৫টি স্বতন্ত্র জাতি আছে এবং সেগুলো নিয়ে ভারতে অন্তত ১৫টি স্বতন্ত্র স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র গড়ে তোলা উচিতÑ এ চিন্তাও সে সময়ে ছিল। এস ওয়াজেদ আলীর ‘ভবিষ্যতের বাঙালি’ গ্রšে’ এই ধারার চিন্তার পরি”ছন্ন প্রকাশ আছে। শেরেবাংলা উত্থাপিত ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে এই ধারার চিন্তা ছিল এবং তাতে ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাধিক এলাকাগুলো নিয়ে একাধিক মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব ছিল। কিš‘ এ ধারার চিন্তা সফল হয়নি। সফল হয়েছে হিন্দু মহাসভার এবং মুসলিম লীগের চিন্তা। শেষ পর্যন্ত জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব অনুযায়ী ভারত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে ইংরেজ শাসন থেকে মুক্ত হয়। ব্রিটিশ-শাসনামলে জাতীয়তাবাদ যথেষ্ট বিকশিত হয়নি, জাতীয়তাবাদের ¯’লাভিষিক্ত হয়েছিল সাম্প্রদায়িকতাবাদ। কংগ্রেসকে প্রভাবিত করেছিল হিন্দু মহাসভা। তাতে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ কার্যক্ষেত্রে হিন্দু-সাম্প্রদায়িকতাবাদে পর্যবসিত হয়েছিল। মুসলিম লীগ জাতীয়তাবাদের বদলে গ্রহণ করেছিল মুসলিম-সাম্প্রদায়িকতাবাদ। আর গোটা প্রক্রিয়ায় আগাগোড়া ক্রিয়াশীল ছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের উরারফব ধহফ ৎঁষব চড়ষরপু.
আমাদের পাকিস্তানকালে পূর্ববাংলায় পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ দানা বাঁধেনি। আর মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদও আবেদন হারায়। পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানে বৈষম্য দ্র“ত বেড়ে যেতে থাকে। সে অব¯’ায় এখানে স্বতন্ত্র বাঙালি সংস্কৃতি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ আবেদনশীল হয় এবং প্রবল থেকে প্রবলতর হতে থাকে। এরই মধ্যে ছয় দফা আন্দোলন, আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। 
উনিশ ও বিশ শতকে বাংলার হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরে ধর্মসংস্কার ও সমাজসংস্কার আন্দোলন, রঙ্গলাল-হেমচন্দ্র-মধুসূদন-নবীনসেনের কাব্যসাধনা, অক্ষয়কুমার-বিদ্যাসাগর-বিবেকানন্দ-ত্রিবেদীর বলিষ্ঠ চিন্তাধারা, বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের সাহিত্য, বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশী আন্দোলন, মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা, কংগ্রেস মুসলিম লীগ ও হিন্দু মহাসভার রাজনীতি, পাকিস্তান আন্দোলন ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা, পূর্ববাংলার রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, পাকিস্তানসহ বাঙালি সংস্কৃতি গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র ইত্যাদির প্রচার, ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি ঘটনা একটি অন্যটির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কে জড়িত। এসবের মধ্যে কারণ-কার্যকরণীয়-করণ সম্পর্ক আছে, স্বার্থের সংঘাত আছে, অন্ধ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আছে, মূল্যবোধ যুক্তিবিচার ও সর্বজনীন কল্যাণবুদ্ধি আছে। এসবের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরবর্তী চার দশকের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে আমাদের অনেকের আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা। 
এই বাস্তবতা থেকে উন্নততর নতুন বাস্তবতায় উত্তীর্ণ হতে হলে দরকার রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার স্বরূপ ও গুর“ত্ব উপলব্ধি করা। তার জন্য জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ ও বিশ্বায়নের ঐতিহাসিক বিকাশ ও প্রকৃতি বুঝতে হবে। রাষ্ট্রের রূপ ও স্বরূপ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করতে হবে। বাংলাদেশে রাষ্ট্র গঠনের জন্য যা যা দরকার, একে একে সবই করতে হবে। দূতাবাসমুখী রাজনীতি বর্জন করতে হবে। কথিত সিভিল সোসাইটিসমূহের রাজনীতিও বর্জন করতে হবে। বিদেশী সব শক্তিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারাদি থেকে দূরে রাখতে হবে।
চলমান রাজনীতির ধারা ধরে বাংলাদেশের রাজনীতির উন্নতি হবে না। সম্পূর্ণ নতুন রাজনীতি লাগবে। রাজনৈতিক দল গঠনে কেন্দ্রীয় গুর“ত্ব দিতে হবে। প্রচলিত কোন দল উন্নত রাজনীতি অবলম্বন করতে পারেÑ উন্নত নতুন দলীয় চরিত্র অর্জন করতে পারে। আবার নতুন দলও গঠিত হতে পারে। দল ও রাষ্ট্রের জন্য রাজনৈতিক আদর্শ অপরিহার্য। আদর্শের ভিত্তিতে বাস্তবসম্মত দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি কর্মসূচি অবলম্বন করে জাতীয় পর্যায়ে কাজ করতে হবে। 
কেবল পঞ্চাশ-ষাট বছরের কিছু বিষয়ে দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ না রেখে দেড় হাজার বছরের গোটা ইতিহাসেÑ বিশেষ করে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার ঘটনাবলি থেকে বাংলাদেশের ৪০ বছর পর্যন্তÑ গোটা ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করতে হবে। বিভিন্ন যুগে, বিভিন্ন ঘটনায় প্রগতিশীল, রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ভূমিকা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করতে হবে এবং ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। ইতিহাসের শিক্ষাকে কাজে না লাগিয়ে প্রগতি সম্ভব নয়। 
নতুনভাবে সর্বাঙ্গীণ চিন্তা ও কাজ আরম্ভ করা হলে আমাদের সামনে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের জনগণের উজ্জ্বল সম্ভাবনা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের জনগণ বাংলাদেশকে নিজেদের উন্নত রাষ্ট্ররূপে গড়ে তুলতে পারলে নিজেদের কল্যাণে সম্ভবপর মানবীয় সবকিছুই অর্জন করতে পারবে। 
আবুল কাসেম ফজলুল হক : শিক্ষাবিদ

শুক্রবার, ৮ জুন, ২০১২

মিয়ানমারে গণতন্ত্র! বাংলাদেশে কী?




আ বু ল কা সে ম ফ জ লু ল হ ক 
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র্র পৃথবীর সব রাষ্ট্রে তার পরিকল্পিত লিবারেল ডেমোক্রেসি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সেই সঙ্গে চায় গোটা পৃথিবীকে ওয়াশিংটনকেন্দ্রিক এক রাষ্ট্রে পরিণত করতে। লিবারেল ডেমোক্রেসির ভিত্তিতে রয়েছে পুঁজিবাদ। যে গ্লোবালাইজেশনের মাধ্যমে ওয়াশিংটনকেন্দ্রিক বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালানো হ”েছ, তারও ভিত্তিতে রয়েছে বিশ্ববিস্তৃত পুঁজিবাদ। লিবারেল ডেমোক্রেসি পুঁজিবাদের স্বার্থে চূড়ান্ত গুর“ত্ব দেয় ভোটাভুটির মাধ্যমে সরকার গঠনে। এ গণতন্ত্রে জনসাধারণকে ব্যবহার করা হয় ধনিক শ্রেণীর স্বার্থে যন্ত্রের মতো। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক রাষ্ট্রে ‘ওকুপাই ওয়াল স্ট্রিট মুভমেন্ট’ নামে যে আন্দোলন চালানো হ”েছ, তাতে আন্দোলনকারীরা স্লোগান তুলছেন, শতকরা নিরানব্বই ভাগকে তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে শতকরা এক ভাগ লোক নিজেদের সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। ওকুপাই ওয়াল স্ট্রিট মুভমেন্টের উদ্দেশ্য বঞ্চনাকারী শতকরা এক ভাগকে সতর্ক করে দিয়ে বাকি নিরানব্বই ভাগের কাছে পুঁজিবাদকে সহনীয় রূপ দেয়া। পুঁজিবাদকে পুনর্গঠিত ও নবায়িত করার আয়োজনের কোন অন্ত নেই। বিশ্বায়নের পুঁজিবাদ কি ক্রমে বিশ্বব্যাপী সবার কাছে সহনীয় হয়ে উঠবে?
জনগণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের লিবারেল ডেমোক্রেসি মারাÍক। যুক্তরাষ্ট্র লিবারেল ডেমোক্রেসিকে আমদানি-রফতানির ব্যাপার মনে করে এবং সে দুর্বল রাষ্ট্রগুলোতে এ ডেমোক্রেসি চালান দিয়ে থাকে। এ ডেমোক্রেসির সঙ্গে আছে তার আধিপত্য ও নির্ভরশীলতা নীতি, পুঁজিবাদী উন্নয়নতত্ত্ব, লগ্নি পুঁজি, প্রচারনীতি, কূটনীতি, সংস্কৃতিনীতি, গোয়েন্দা কার্যক্রম, যুদ্ধের আয়োজন ইত্যাদি। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে লিবারেল ডেমোক্রেসি কায়েম করতে উদগ্রীব এবং ভীষণভাবে কর্মতৎপর। বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটির বুদ্ধিজীবীরা এ দেশে লিবারেল ডেমোক্রেসির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে কাজ করে চলছেন। যুক্তরাষ্ট্রের লিবারেল ডেমোক্রেসি প্রবর্তনের সর্বোৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত দেখা গেছে আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়ায়। চীন ও রাশিয়ার অসহযোগিতার কারণে সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র এখনও লিবারেল ডেমোক্রেসি কায়েম করে উঠতে পারছে না। তবে সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি প্রভৃতি রাষ্ট্রের সর্বাÍক ‘গণতান্ত্রিক’ আয়োজনের বিরাম নেই!
গত সিকি শতাব্দী ধরে মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের অন্তহীন তৎপরতা দেখা যা”েছ। মিয়ানমার চীনসংলগ্ন ও নিকটবর্তী। চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে এ রাষ্ট্রটি চলছে। এ রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে রয়েছে গভীর দেশপ্রেম। জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে বিদেশীদের কর্তৃত্ব তারা পছন্দ করে না। সেই ১৯৬২ সাল থেকে এ রাষ্ট্রে চলছে সেনাবাহিনীর শাসন। সেনাবাহিনীর শাসনকে কায়েম রাখার নীতি নিয়েই প্র¯‘ত করা হয়েছে এ রাষ্ট্রের সংবিধান।
আজকের পৃথিবীতে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে মনে করে তার এক নম্বর শত্র“। চীনকে কাবু করার কাজে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা মিয়ানমারকে ঘাঁটি-এলাকা হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। কিš‘ সে রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সরকার কিছুতেই সেটা অনুমোদন করে না। সেজন্যই যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারে ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার নামে তার পছন্দমতো সরকার বসাতে উদগ্রীব ও তৎপর। যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারে লিবারেল ডেমোক্রেসি কায়েম করার উদ্দেশ্যে অং সান সু চিকে কাজে লাগানোর জন্য নোবেল পুরস্কার দিয়ে মনের মতো করে তৈরি করে নিয়েছে। বাংলাদেশে যেমন নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ড. মুহাম্মদ ইউনূস, মিয়ানমারে তেমনি নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অং সান সু চি! ইউনূস প্রচার করেছিলেন যোগ্য প্রার্থী আন্দোলনের তত্ত্ব, যার পরিণতিতে ২০০৭ সালে হয়েছিল জর“রি অব¯’া।
মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর শাসনের জায়গায় অং সান সু চির নেতৃত্বে লিবারেল ডেমোক্রেসি কায়েম হ”েছ দেখে বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটিগুলোর বুদ্ধিজীবীরা খুব খুশি। কিš‘ মিয়ানমারে তাদের পথেরই অগ্রযাত্রী পথিক অং সান সু চি কিš‘ এরই মধ্যে অন্য রকম কথা বলতে শুর“ করেছেন। ড. ইউনূসের মতোই অনেক ভালো ভালো কথা বলার মধ্যে তিনি বলছেন, মিয়ানমারে গণতন্ত্র ও উন্নয়ন নিয়ে এখনই খুব আশাবাদী হওয়া ঠিক নয়। তিনি বলেছেন, অনেক সমস্যা আছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও চীন মিয়ানমারকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করতে চায়।’ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভূমিকা তিনি আলাদা করে স্পষ্ট করেননি। যেভাবে তিনি কথা বলেছেন তাতে মনে হয়, তার অব¯’ান চীনের বির“দ্ধে। মিয়ানমার কি গণতন্ত্র নিয়ে এখন চীনের বির“দ্ধে অব¯’ান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোলে চলে যাবে? সু চির একটি বক্তব্য সম্পর্কে ঢাকার পত্রপত্রিকায় বলা হয়েছে : ‘মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। সামরিক শাসন অবসানের পর প্রাকৃতিক সম্পদে ভরা দেশটির সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহী হয় যুক্তরাষ্ট্রও। গণতান্ত্রিক সংস্কারের পুরস্কার হিসেবে তারা মিয়ানমারের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা শিথিলও করেছে। মিয়ানমারের ওপর দেশ দুটির প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিরোধীদলীয় নেতা অং সান সু চি। মিয়ানমার যেন যুদ্ধক্ষেত্র না হয় সে ব্যাপারে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে দিয়েছেন তিনি।’ চীনকে তাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র ঢুকতে চাইছে। তাতেই সু চি সমস্যা দেখছেন।
থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে পূর্ব এশিয়াবিষয়ক বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের তিন দিনের সম্মেলনে শুক্রবার, ১ জুন, ২০১২, সু চি এ বক্তব্য দেন। খবরে বলা হয়েছেÑ ‘মিয়ানমার নিয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে ঠেলাঠেলি শুর“ করেছে, সে ব্যাপারে শংকা প্রকাশ করেন সু চি। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ মুহূর্তে বেশি করে জড়িয়ে পড়লে মিয়ানমারের অব¯’া কী হবে এবং চীনের সঙ্গে থাকার ফল কী হবে, তা নিয়ে অনেকেই কথা বলছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের যুদ্ধক্ষেত্র হবে মিয়ানমারÑ এ বিষয়টি ভেবে আমি শংকিত।’ সু চির শংকা কি অমূলক?
আসলে মিয়ানমার কিভাবে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গাঁটছড়াবদ্ধ হবে, সেটাই মূল সমস্যা। সু চি আশংকা প্রকাশ করেছেন মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির সম্ভাবনা দেখেও। বেকার সমস্যা নিয়েও তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তবে কেন্দ্রীয় সমস্যা তিনি দেখেছেন চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক নিয়ে।
প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে, সত্তর দশকের অন্তে ও আশি দশকের শুর“তে তারাকি, হাফিজুল্লাহ আমিন ও বারবাক কারমালের শাসনকালে আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে মস্কো ও ওয়াশিংটনের প্রতিযোগিতার কথা। মস্কো আফগানিস্তানে লক্ষাধিক সৈন্য পাঠিয়েছিল নতুন শাসকদের রক্ষা করার জন্য, আর ওয়াশিংটন পাকিস্তানকে পশ্চাৎপটে রেখে গড়ে তুলেছিল তালেবানদের। ওই সব ঘটনার পরিণতি কী হয়েছে, তা বিশ্বব্যাপী বিবেকবান, চিন্তাশীল সবারই ভেবে দেখা আর মিয়ানমারের ঘটনা নিয়ে কর্তব্য নির্ধারণ করা কর্তব্য। মিয়ানমার সমস্যা সামান্য ব্যাপার নয়। এর পরিণতি যুগান্তকারী হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র, আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে গণতন্ত্র কায়েম করেছে, তাতে এমনটা অসম্ভব নয় যে, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স চীনের পার্শ্ববর্তী মিয়ানমারে বিমান বাহিনী, জলবাহিনী ও ¯’লবাহিনী পাঠিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হবে এবং ন্যাটো বাহিনীকে সেখানে নামাবে। সু চি মিয়ানমারে চীন আর যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে যেমন মনে করছেন, আসলে ব্যাপার কি তাই? ন্যায়-অন্যায়ের বিচারে চীন আর যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কি এক রকম? যুক্তরাষ্ট্র কি চীনকে ধ্বংস করে দিতে পারবে? বৈশ্বিক ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র কি তার আধিপত্যনীতি ও স্বে”ছাচার-স্বৈরাচার নিয়ে চলতে থাকবে? বিশ্ববাসী কেবল নীরব ও নিষ্ক্রিয়ই থাকবে? বাংলাদেশের কী হবে?
এরই মধ্যে চীন ও উত্তর কোরিয়ার বির“দ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় ও বঙ্গোপসাগরে সামরিক আয়োজন বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। যুক্তরাষ্ট্র কিছু বিষয়ের ঘোষণা দি”েছ, অনেক বিষয়েরই ঘোষণা দি”েছ না। যুক্তরাষ্ট্র তার ¯’ায়ী পরিকল্পনা প্রতিরোধের মধ্যে পড়তে পারে বলে অ¯’ায়ী প্রকল্পের ঘোষণা দিয়ে কাজ করবে বলে খবরে প্রকাশ। এরই মধ্যে ভারতের অনলাইন পত্রিকা টাইমস অব ইন্ডিয়া খবর প্রকাশ করেছে, বাংলাদেশসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্র রণতরীর ঘাঁটি তৈরি করতে যা”েছ। আমেরিকার সপ্তম নৌবহর চট্টগ্রামে ঘাঁটি গাড়ছে বলেও ওই অনলাইন পত্রিকা খবর প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ সরকার ও যুক্তরাষ্ট্র সরকার এ খবরের সত্যতা অস্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে। এসব বিবৃতি সত্ত্বেও জনমন এ ব্যাপারে সংশয়ের মধ্যে আছে। ভারত সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আয়োজনের সংবাদে এরই মধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এরই মধ্যে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত সাংগ্রিলা সংলাপে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিওন প্যানেট্টা এশিয়ায় তাদের নৌশক্তি বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছেন।
মিয়ানমারে কোন কিসিমের গণতন্ত্র কতখানি হবে, এখনই বলা কঠিন। কারণ মিয়ানমার গণতন্ত্রের জন্য কতখানি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে বলা যায় না। তবে এটা বলা যায়, জনগণের গণতন্ত্র হবে না। কারণ জনগণকে প্র¯‘ত না করে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া হ”েছ লিবারেল ডেমোক্রেসি। আর মিয়ানমারে যে গণতন্ত্র এখন শুর“ হয়েছে তাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে আশাবাদী হয়ে উঠেছে এবং মিয়ানমারকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে চীনবিরোধী সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলতে অগ্রসর হ”েছ, তাতে পৃথিবী আবার দ্বিকেন্দ্রিক রূপ নিতে পারে। আগের দ্বিকেন্দ্রিকতার আদর্শগত ব্যাপার ছিল, এখন কি পৃথিবীতে নতুন করে আদর্শগত ব্যাপার দেখা দেবে? আগে উল্লেখ করেছি, বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের নৌঘাঁটি ¯’াপনের সংবাদে ভারতও নির“দ্বেগে নেই। ভারত কি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বে লাভবান হ”েছ?
বাংলাদেশের চারপাশে চলছে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আয়োজন। একটু দূরে আছে রাশিয়া। রাশিয়াও নিশ্চিন্তে নেই। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে আছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপান। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কেমন হওয়া উচিত? যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা বাংলাদেশের জন্য কতটা লাভজনক হ”েছ? বন্ধুত্ব নয়, বড় শক্তির কাছে আÍসমর্পণ করে চলা!
আবুল কাসেম ফজলুল হক : শিক্ষাবিদ