শুক্রবার, ৮ জুন, ২০১২

মিয়ানমারে গণতন্ত্র! বাংলাদেশে কী?




আ বু ল কা সে ম ফ জ লু ল হ ক 
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র্র পৃথবীর সব রাষ্ট্রে তার পরিকল্পিত লিবারেল ডেমোক্রেসি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সেই সঙ্গে চায় গোটা পৃথিবীকে ওয়াশিংটনকেন্দ্রিক এক রাষ্ট্রে পরিণত করতে। লিবারেল ডেমোক্রেসির ভিত্তিতে রয়েছে পুঁজিবাদ। যে গ্লোবালাইজেশনের মাধ্যমে ওয়াশিংটনকেন্দ্রিক বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালানো হ”েছ, তারও ভিত্তিতে রয়েছে বিশ্ববিস্তৃত পুঁজিবাদ। লিবারেল ডেমোক্রেসি পুঁজিবাদের স্বার্থে চূড়ান্ত গুর“ত্ব দেয় ভোটাভুটির মাধ্যমে সরকার গঠনে। এ গণতন্ত্রে জনসাধারণকে ব্যবহার করা হয় ধনিক শ্রেণীর স্বার্থে যন্ত্রের মতো। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক রাষ্ট্রে ‘ওকুপাই ওয়াল স্ট্রিট মুভমেন্ট’ নামে যে আন্দোলন চালানো হ”েছ, তাতে আন্দোলনকারীরা স্লোগান তুলছেন, শতকরা নিরানব্বই ভাগকে তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে শতকরা এক ভাগ লোক নিজেদের সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। ওকুপাই ওয়াল স্ট্রিট মুভমেন্টের উদ্দেশ্য বঞ্চনাকারী শতকরা এক ভাগকে সতর্ক করে দিয়ে বাকি নিরানব্বই ভাগের কাছে পুঁজিবাদকে সহনীয় রূপ দেয়া। পুঁজিবাদকে পুনর্গঠিত ও নবায়িত করার আয়োজনের কোন অন্ত নেই। বিশ্বায়নের পুঁজিবাদ কি ক্রমে বিশ্বব্যাপী সবার কাছে সহনীয় হয়ে উঠবে?
জনগণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের লিবারেল ডেমোক্রেসি মারাÍক। যুক্তরাষ্ট্র লিবারেল ডেমোক্রেসিকে আমদানি-রফতানির ব্যাপার মনে করে এবং সে দুর্বল রাষ্ট্রগুলোতে এ ডেমোক্রেসি চালান দিয়ে থাকে। এ ডেমোক্রেসির সঙ্গে আছে তার আধিপত্য ও নির্ভরশীলতা নীতি, পুঁজিবাদী উন্নয়নতত্ত্ব, লগ্নি পুঁজি, প্রচারনীতি, কূটনীতি, সংস্কৃতিনীতি, গোয়েন্দা কার্যক্রম, যুদ্ধের আয়োজন ইত্যাদি। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে লিবারেল ডেমোক্রেসি কায়েম করতে উদগ্রীব এবং ভীষণভাবে কর্মতৎপর। বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটির বুদ্ধিজীবীরা এ দেশে লিবারেল ডেমোক্রেসির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে কাজ করে চলছেন। যুক্তরাষ্ট্রের লিবারেল ডেমোক্রেসি প্রবর্তনের সর্বোৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত দেখা গেছে আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়ায়। চীন ও রাশিয়ার অসহযোগিতার কারণে সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র এখনও লিবারেল ডেমোক্রেসি কায়েম করে উঠতে পারছে না। তবে সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি প্রভৃতি রাষ্ট্রের সর্বাÍক ‘গণতান্ত্রিক’ আয়োজনের বিরাম নেই!
গত সিকি শতাব্দী ধরে মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের অন্তহীন তৎপরতা দেখা যা”েছ। মিয়ানমার চীনসংলগ্ন ও নিকটবর্তী। চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে এ রাষ্ট্রটি চলছে। এ রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে রয়েছে গভীর দেশপ্রেম। জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে বিদেশীদের কর্তৃত্ব তারা পছন্দ করে না। সেই ১৯৬২ সাল থেকে এ রাষ্ট্রে চলছে সেনাবাহিনীর শাসন। সেনাবাহিনীর শাসনকে কায়েম রাখার নীতি নিয়েই প্র¯‘ত করা হয়েছে এ রাষ্ট্রের সংবিধান।
আজকের পৃথিবীতে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে মনে করে তার এক নম্বর শত্র“। চীনকে কাবু করার কাজে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা মিয়ানমারকে ঘাঁটি-এলাকা হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। কিš‘ সে রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সরকার কিছুতেই সেটা অনুমোদন করে না। সেজন্যই যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারে ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার নামে তার পছন্দমতো সরকার বসাতে উদগ্রীব ও তৎপর। যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারে লিবারেল ডেমোক্রেসি কায়েম করার উদ্দেশ্যে অং সান সু চিকে কাজে লাগানোর জন্য নোবেল পুরস্কার দিয়ে মনের মতো করে তৈরি করে নিয়েছে। বাংলাদেশে যেমন নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ড. মুহাম্মদ ইউনূস, মিয়ানমারে তেমনি নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অং সান সু চি! ইউনূস প্রচার করেছিলেন যোগ্য প্রার্থী আন্দোলনের তত্ত্ব, যার পরিণতিতে ২০০৭ সালে হয়েছিল জর“রি অব¯’া।
মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর শাসনের জায়গায় অং সান সু চির নেতৃত্বে লিবারেল ডেমোক্রেসি কায়েম হ”েছ দেখে বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটিগুলোর বুদ্ধিজীবীরা খুব খুশি। কিš‘ মিয়ানমারে তাদের পথেরই অগ্রযাত্রী পথিক অং সান সু চি কিš‘ এরই মধ্যে অন্য রকম কথা বলতে শুর“ করেছেন। ড. ইউনূসের মতোই অনেক ভালো ভালো কথা বলার মধ্যে তিনি বলছেন, মিয়ানমারে গণতন্ত্র ও উন্নয়ন নিয়ে এখনই খুব আশাবাদী হওয়া ঠিক নয়। তিনি বলেছেন, অনেক সমস্যা আছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও চীন মিয়ানমারকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করতে চায়।’ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভূমিকা তিনি আলাদা করে স্পষ্ট করেননি। যেভাবে তিনি কথা বলেছেন তাতে মনে হয়, তার অব¯’ান চীনের বির“দ্ধে। মিয়ানমার কি গণতন্ত্র নিয়ে এখন চীনের বির“দ্ধে অব¯’ান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোলে চলে যাবে? সু চির একটি বক্তব্য সম্পর্কে ঢাকার পত্রপত্রিকায় বলা হয়েছে : ‘মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। সামরিক শাসন অবসানের পর প্রাকৃতিক সম্পদে ভরা দেশটির সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহী হয় যুক্তরাষ্ট্রও। গণতান্ত্রিক সংস্কারের পুরস্কার হিসেবে তারা মিয়ানমারের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা শিথিলও করেছে। মিয়ানমারের ওপর দেশ দুটির প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিরোধীদলীয় নেতা অং সান সু চি। মিয়ানমার যেন যুদ্ধক্ষেত্র না হয় সে ব্যাপারে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে দিয়েছেন তিনি।’ চীনকে তাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র ঢুকতে চাইছে। তাতেই সু চি সমস্যা দেখছেন।
থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে পূর্ব এশিয়াবিষয়ক বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের তিন দিনের সম্মেলনে শুক্রবার, ১ জুন, ২০১২, সু চি এ বক্তব্য দেন। খবরে বলা হয়েছেÑ ‘মিয়ানমার নিয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে ঠেলাঠেলি শুর“ করেছে, সে ব্যাপারে শংকা প্রকাশ করেন সু চি। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ মুহূর্তে বেশি করে জড়িয়ে পড়লে মিয়ানমারের অব¯’া কী হবে এবং চীনের সঙ্গে থাকার ফল কী হবে, তা নিয়ে অনেকেই কথা বলছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের যুদ্ধক্ষেত্র হবে মিয়ানমারÑ এ বিষয়টি ভেবে আমি শংকিত।’ সু চির শংকা কি অমূলক?
আসলে মিয়ানমার কিভাবে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গাঁটছড়াবদ্ধ হবে, সেটাই মূল সমস্যা। সু চি আশংকা প্রকাশ করেছেন মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির সম্ভাবনা দেখেও। বেকার সমস্যা নিয়েও তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তবে কেন্দ্রীয় সমস্যা তিনি দেখেছেন চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক নিয়ে।
প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে, সত্তর দশকের অন্তে ও আশি দশকের শুর“তে তারাকি, হাফিজুল্লাহ আমিন ও বারবাক কারমালের শাসনকালে আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে মস্কো ও ওয়াশিংটনের প্রতিযোগিতার কথা। মস্কো আফগানিস্তানে লক্ষাধিক সৈন্য পাঠিয়েছিল নতুন শাসকদের রক্ষা করার জন্য, আর ওয়াশিংটন পাকিস্তানকে পশ্চাৎপটে রেখে গড়ে তুলেছিল তালেবানদের। ওই সব ঘটনার পরিণতি কী হয়েছে, তা বিশ্বব্যাপী বিবেকবান, চিন্তাশীল সবারই ভেবে দেখা আর মিয়ানমারের ঘটনা নিয়ে কর্তব্য নির্ধারণ করা কর্তব্য। মিয়ানমার সমস্যা সামান্য ব্যাপার নয়। এর পরিণতি যুগান্তকারী হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র, আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে গণতন্ত্র কায়েম করেছে, তাতে এমনটা অসম্ভব নয় যে, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স চীনের পার্শ্ববর্তী মিয়ানমারে বিমান বাহিনী, জলবাহিনী ও ¯’লবাহিনী পাঠিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হবে এবং ন্যাটো বাহিনীকে সেখানে নামাবে। সু চি মিয়ানমারে চীন আর যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে যেমন মনে করছেন, আসলে ব্যাপার কি তাই? ন্যায়-অন্যায়ের বিচারে চীন আর যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কি এক রকম? যুক্তরাষ্ট্র কি চীনকে ধ্বংস করে দিতে পারবে? বৈশ্বিক ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র কি তার আধিপত্যনীতি ও স্বে”ছাচার-স্বৈরাচার নিয়ে চলতে থাকবে? বিশ্ববাসী কেবল নীরব ও নিষ্ক্রিয়ই থাকবে? বাংলাদেশের কী হবে?
এরই মধ্যে চীন ও উত্তর কোরিয়ার বির“দ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় ও বঙ্গোপসাগরে সামরিক আয়োজন বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। যুক্তরাষ্ট্র কিছু বিষয়ের ঘোষণা দি”েছ, অনেক বিষয়েরই ঘোষণা দি”েছ না। যুক্তরাষ্ট্র তার ¯’ায়ী পরিকল্পনা প্রতিরোধের মধ্যে পড়তে পারে বলে অ¯’ায়ী প্রকল্পের ঘোষণা দিয়ে কাজ করবে বলে খবরে প্রকাশ। এরই মধ্যে ভারতের অনলাইন পত্রিকা টাইমস অব ইন্ডিয়া খবর প্রকাশ করেছে, বাংলাদেশসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্র রণতরীর ঘাঁটি তৈরি করতে যা”েছ। আমেরিকার সপ্তম নৌবহর চট্টগ্রামে ঘাঁটি গাড়ছে বলেও ওই অনলাইন পত্রিকা খবর প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ সরকার ও যুক্তরাষ্ট্র সরকার এ খবরের সত্যতা অস্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে। এসব বিবৃতি সত্ত্বেও জনমন এ ব্যাপারে সংশয়ের মধ্যে আছে। ভারত সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আয়োজনের সংবাদে এরই মধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এরই মধ্যে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত সাংগ্রিলা সংলাপে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিওন প্যানেট্টা এশিয়ায় তাদের নৌশক্তি বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছেন।
মিয়ানমারে কোন কিসিমের গণতন্ত্র কতখানি হবে, এখনই বলা কঠিন। কারণ মিয়ানমার গণতন্ত্রের জন্য কতখানি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে বলা যায় না। তবে এটা বলা যায়, জনগণের গণতন্ত্র হবে না। কারণ জনগণকে প্র¯‘ত না করে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া হ”েছ লিবারেল ডেমোক্রেসি। আর মিয়ানমারে যে গণতন্ত্র এখন শুর“ হয়েছে তাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে আশাবাদী হয়ে উঠেছে এবং মিয়ানমারকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে চীনবিরোধী সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলতে অগ্রসর হ”েছ, তাতে পৃথিবী আবার দ্বিকেন্দ্রিক রূপ নিতে পারে। আগের দ্বিকেন্দ্রিকতার আদর্শগত ব্যাপার ছিল, এখন কি পৃথিবীতে নতুন করে আদর্শগত ব্যাপার দেখা দেবে? আগে উল্লেখ করেছি, বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের নৌঘাঁটি ¯’াপনের সংবাদে ভারতও নির“দ্বেগে নেই। ভারত কি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বে লাভবান হ”েছ?
বাংলাদেশের চারপাশে চলছে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আয়োজন। একটু দূরে আছে রাশিয়া। রাশিয়াও নিশ্চিন্তে নেই। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে আছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপান। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কেমন হওয়া উচিত? যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা বাংলাদেশের জন্য কতটা লাভজনক হ”েছ? বন্ধুত্ব নয়, বড় শক্তির কাছে আÍসমর্পণ করে চলা!
আবুল কাসেম ফজলুল হক : শিক্ষাবিদ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন